মঙ্গলবার ১৪ মে ২০২৪
Online Edition

জীবনঘুড়ির আকাশ দেখা

 

সাজজাদ হোসাইন খান:

।।পঁয়ত্রিশ ।।

ঢাকা কোনো অপরিচিত যায়গা নয়। এর আগেও ঢাকায় ছিলাম। বানর, ঘোড়ার গাড়ি, আর লোহার পুল মনের কপাটে ঝুনঝুনি বাজায় সময় অসময়ে। আবার ঢাকা যাবো চোখের তারায় খুশির ঝরনা। ঝরনার অন্য পিঠে কান্নার টুপটাপ শব্দ। অশোকতলার অশোক গাছ, কান্দিরপাড়, বাদুড়তলা, রামচন্দ্র পাঠশালা, সব বুঝি চলে যাবে আড়ালে। দু’দিন বাদেই আব্বা কুমিল্লা ছাড়লেন। আমরা রয়ে গেলাম অশোকতলার ঝির ঝিরে হাওয়ায়। পাশের বাসার দুলুরা আসে। দুলুর আম্মা আসেন। অনেকটা সময়ই কাটিয়ে যান আড্ডাফাড্ডা দিয়ে। বন্ধুবান্ধবরা আসে  খোঁজখবর নেয় আমার। ইচ্ছার ঘরগুলোতে অন্ধকার ঢুকছে হু হু করে। হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছি বারবার। এরই মধ্যে মেজোমামা এসে হাজির। হতাশার আকাশে যেনো তারা ফুটলো। এই মামা ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে পড়াশোনা করেন। মামাকে পেয়ে আমিও খুশি, আম্মার চোখেও আলো ঝলমল। সময়ের কাঁটা ঘুরছে ভোঁ ভোঁ। মেজোমামা খবরাখবর নিলেন পরীক্ষার। পড়াশোনার আশয় বিষয়। আমিও হুটহাট জবাব দিলাম। আমার মাথা চুলকে দিলেন মামা আনন্দে। রাত ফর্সা হলেই পরীক্ষা। আম্মা সব গোছগাছ করে রাখলেন, পেনসিল কালি কলম। 

শত হোক বার্ষিক পরীক্ষা। বুক তো দুরুদুরু করবেই। রহমান, উদয়ন, মিনার চোখেও আলো আঁধারী ভাব। তিনজন করে বসেছিলাম এক টুলে। তবে মাঝের ছাত্রটি ছিল অন্য ক্লাশের। দেখতে দেখতে সপ্তা পার। 

পরীক্ষার সবুজ পাতায় হলুদ রঙের ছোপ। হালকা হালকা লাগছে শরীর মন। আনন্দ লাফিয়ে উঠতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে। কুমিল্লা ত্রিপুরা অশোকতলা এ নামগুলো উড়ছে বাতাসে। চোখের দেয়ালে রামচন্দ্র পাঠশালা-রাণীর বাজার। বেলা শেষ হয়ে এলো। আগামীকালই কুমিল্লা ছাড়ছি আমরা। উনিশ শ’ আটান্ন সালের শেষ দিন। মণি দুটো সাঁতার কাটছে চোখের দীঘিতে। বিদায়ের সময় যেমনটা হয়। ভোরে ভোরে কুমিল্লা ছাড়লাম। থামবো গিয়ে আশুগঞ্জ। তারপর নৌকায় নানাবাড়ি, আগানগর। 

এবার অন্য নিয়মে বসলাম আমরা। এক কামড়ায় উঠলাম আমি আর মেজমামা। অন্য কামড়ায় আম্মা। মহিলারা যে কামড়ায় বসেন। মামাকে জিজ্ঞেস করলাম এমন কেন? আমি তো আম্মার সাথে বসি। মামা হাসলেন। বললেন তুমিতো বড় হয়ে গেছো। আরো ছোটরা আম্মার সাথে থাকে। আম্মার জন্যে কেমন কেমন লাগছিল। আর কি করা বসে থাকলাম চুপচাপ। চলতে শুরু করলো রেলগাড়ি ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করে। আগে বাড়ছে আমাদের গাড়ি। পিছনে পড়ে থাকলো কুমিল্লা, কান্দির পাড়, অশোকতলা। মনের তলা কাটছে ঘুণপোকা কুট কুট। কামড়ার ভিতরেও ফেরিওয়ালাদের দৌড়ঝাপ। মামাকে বললাম কই আম্মাদের কামড়ায়তো ফেরিওয়ালাদের দেখা পাইনি! মামা জানালেন মহিলাদের গাড়িতে ওদের উঠতে বারণ। তাই ফেরিওয়ালারা সে কামড়ায় যায় না। বুঝতে চেষ্টা করলাম মামার চোখে চোখ রেখে। ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক কান ঝালাপালা। 

মামা জানতে চাইলেন কি খাবো। আমি ঝট করে বললাম চানাচুর। মামা কতক সময় চুপ থেকে জানালেন চানাচুর ভালো হবে না, পেট খারাপ করে। তুমি বরং কলা খাও। চার পয়সায় চারটি কলা কিনলেন মামা বিশাল বিশাল। আমি এক কলার আধ পর্যন্ত এসেই হাঁফিয়ে উঠলাম। আমার কাউসালি দেখে মামা হাসলেন। রেলগাড়ি দৌড়াচ্ছে ঘোড়ার মতো বাতাসের চাদর এফোঁড় ওফোঁড় করে। বেশ কতক জায়গায়ই গাড়ি থামলো। উঠানামা করলো মানুষ। তারপর বারকয়েক চিৎকার। আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে কালো ধোঁয়া। ঝিক ঝিক শব্দের পর চলতে শুরু করে গাড়ি। জানালার বাইরে মেলে দিলাম নজর। কোথাও সারি সারি গাছ, ফসলের মাঠ দুলছে বাতাসে। কখন যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পার হয়ে এসেছি বুঝতেই পারলাম না। আবার ঝিক ঝিক শব্দ করে দাঁড়িয়ে গেল রেলগাড়ি। মামা তাগিদ দিলেন উঠো। আমরা এসে গেছি। আশুগঞ্জ স্টেশন। আগ থেকেই পরিচয়। পথ-ঘাট চেনা-জানা। ঢাল বেয়ে নামতে হবে নিচে। তারপর খেয়াঘাট। কাতারবন্দি নৌকা। আমরা যখন রেল থেকে নামলাম, তখন কান বরাবর ঝুলছে সূর্য। (চলবে)

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ